দেশজুড়ে

রামনাথের ভূতনাথ-সুজন উল্লা

প্রিন্ট করুন

পুরোনো ভাঙাচুরা দালানটি প্রায় শতবছরের ও বেশি সময় ধরে এখনও দাড়িয়ে আছে নিজের প্রভূ রামনাথের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে।গায়ের আস্তরণ প্রলেপ অনেক আগেই খঁসে পড়েছে।ইটের গায়ে শেওলা জমেছে।এখন শুধু অপেক্ষার প্রহর গুনছে কবে তাকে অলংকরনে সজ্জিত করা হবে।কবে তাকে প্রাপ্য সম্মান দেয়া হবে।কবেই বা তার গায়ে প্রভূ রামনাথের নাম প্রতিধ্বনিত হবে।
শুনেছি রামনাথের মৃত্যুর পর, উনার অদৃশ্য বন্ধু ভূতনাথ নাকি এখন ওই দালানে বসত করেন।রামনাথ যে দালান কোটায় নিদ্রা বাস করতেন,
সেখানে তিনি প্রতিশোধের নেশায় প্রহর গুনছেন।কখন অবৈধ দখলদার বাহিনীকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে ঘাড় মটকে বিতাড়িত করবেন এবং নিজের বন্ধু রামনাথের আত্মাকে শান্তি দিবেন।মাঝে মাঝে গভীর রাতে কাঁন্নার আওয়াজ শুনতে পান এলাকাবাসী।তাই এলাকার কেউ ভয়ে ওই পুরোনো জরাজীর্ণ দালানটির ভিতরে প্রবেশ করেননা।লোকজন বলাবলি করছিলো ভূতনাথের ভয়ে নাকি অবৈধ দখলদার এখনও দালানটি ভাঙতে পারেননি।বহুবার দালান ভাঙার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে,তাতে ব্যর্থ হয়েছে তারা।এলাকার প্রবীন দাদু বলছিলেন দালানটিতে ভূতনাথের অদৃশ্য শক্তির প্রভাব রয়েছে,এজন্য দালান ভাঙা সম্ভব নয়।দালান ভাঙার কথা ভাবলেই অসুস্থ্য হয়ে পড়েন অবৈধ দখলদার সাহেব।শুধু তাই নয়,ওঝা কবিরাজের পানিপড়া,ঝাড়ফোক,এমনকি বড় মৌলভী দিয়ে ভূতনাথকে তাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে।তাতেও পরাজিত হয় ভূমিখেকোর দল।
কোন এক রাতের বেলা রামনাথের শয়নকক্ষে
(বর্তমানে ভূতনাথের শয়নকক্ষ)প্রবেশ করেন খাটো মিয়া,এসময় ভূতনাথের থাপ্পর খেয়ে দীর্ঘ এক ঘন্টা বেহুশ ছিলেন তিনি।জেগে দেখেন শৌঁচাগারে শুয়ে আছেন বস্ত্রহীন অবস্থায়।শুধু তাই নয় ভূতনাথের থাপ্পরের ফলে একটানা সাতদিন শরীরে প্রচন্ড তাপ নিয়ে কাটাতে হয়েছে তাকে।এরকম শত শত ভৌতিক ঘটনার গল্প রয়েছে বাংলার প্রথম ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসত বাড়িটি ঘিরে।যা এখনও ওই এলাকার প্রবীন মুরুব্বী ও লোকমূখে শুনা যায়।
বাইসাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণকারী রামনাথ বিশ্বাস এবং তার শৈশব কাটানো পৈতৃক ভিটা নিয়ে লিখলে তা হয়তো লিখে শেষ করা যাবেনা।রামনাথ বিশ্বাস যেসকল দেশে ভ্রমণ করেছেন,তার সেই ভ্রমণ কাহিনী বিশ্ববাসীকে জানাতে তার উপর লিখেছেন অসংখ্য ভ্রমণ বিষয়ক বই।রামনাথ রচিত বই পড়ে অনুপ্রানিত হয়ে গত ১১ সেপ্টেম্বর রামনাথের শৈশব কাটানো পৈতৃক ভিটা দেখতে ঢাকা থেকে বানিয়াচং আসেন পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক বিডি নিউজ২৪ এর এ্যাসাইনমেন্ট এডিটর রাজিব নুর সাহেব।বানিয়াচং প্রেসক্লাবের সভাপতি ও কালের কন্ঠ পত্রিকার প্রতিনিধি সাহেদ নুর,দেশসেবা পত্রিকার প্রতিনিধি আলমগীর রেজা ও সমাচার প্রতিনিধি তৌহিদ মিয়াকে সাথে নিয়ে রামনাথের বাড়িতে যান।সেখানে শতবছরের পুরোনো রামনাথের জরাজীর্ণ দালানের ছবি তুলতে গেলে বাড়িটির অবৈধ দখলদার ওয়াহিদ মিয়া এবং তার ছেলেরা তাদের উপর হামলা চালায়।কেড়ে নেয় প্রত্যেকের মোবাইল ফোন।পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় প্রাণে বাঁচেন তারা।স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসার পর বানিয়াচং থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন আহত সাংবাদিকরা।চার সাংবাদিকের উপর হামলার ঘটনা মূহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।হামলার ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে শুরু হয় মানববন্ধন।শেষ পর্যন্ত হামলা কারীদের মধ্যে ওয়ালিদ নামে একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।আদালতে প্রেরণের পর আইনের ফাকফোকড়ে জামিনে মুক্তি পায় দখলদার বাহিনী।সাংবাদিকদের উপর হামলার পরপরই রামনাথ প্রেমীদের মধ্যে রামনাথের বসতবাড়ি পুনরুদ্ধার করতে কেন্দ্রীয়ভাবে গঠন করা হয় পুনরুদ্ধার কমিটি।বিশ্ব পর্যটন দিবসে প্রতিবাদ স্বরুপ বানিয়াচংয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাংবাদিকদের নিয়ে প্রতীকি অনশনে বসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশ পত্রিকার সহ সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু ওইদিনই হবিগঞ্জ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাইসাকেলে করে শত শত ক্ষুদে রামনাথের আগমন ঘটে রামনাথ বিশ্বাসের বাড়িতে।তখন নির্বাক হয়ে দাড়িয়ে ছিলেন অবৈধ দখলদার ওয়াহেদ বাহিনী।দেশবাসী এবং রামনাথ প্রেমীদের দাবি রামনাথের বসতভিটা পুনরুদ্ধার করে ভ্রমণ বিষয়ক বইয়ের একটি বিশেষায়িত পাঠাগার, বাইসাকেল মিউজিয়াম এবং বিশ্রামাগার করা হউক।সেই লক্ষ্যে রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটির উদ্যোগে রামনাথ বিশ্বাসের প্রয়াণ দিবস-১লা নভেম্বর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে সূধীজনদের নিয়ে একটি সেমিনার অনুষ্টিত হবে।ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের সংক্ষিপ্ত জীবনীর তথ্যমতে-রামনাথ বিশ্বাস ১৮৯৪ সালের ১৩ জানুযারী বানিয়াচংয়ের বিদ্যাভূষণ পাড়ার এক সম্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহন করেন।বাবা বিরাজনাথ বিশ্বাস এবং গুনময়ী দেবীর দ্বিতীয় পুত্র তিনি।শিশুকালেই বাবা মাকে হারান তিনি।বড় ভাই কৃপানাথের মায়া মমতায় উনার সংসারে ঠাই হয় তার।গায়ের পাঠশালায় অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।শতবর্ষ আগে নিজ বাড়ি থেকে বাইসাইকেল নিয়ে ভূ-পর্যটনে বের হন রামনাথ।শুধু দেশে দেশে ভ্রমণ করেই ক্ষ্যান্ত হননি তিনি”বাঙালির ঘরকুনো অপবাদ ঘুচানোর পাশাপাশি লিখেছেন ভ্রমণ বিষয়ক গোটা চল্লিশেক বই।ভ্রমণ পিপাসু এই মানুষটি থিতু হতে চেয়েছিলেন নিজ গ্রাম বানিয়াচংয়ে।কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কলকাতায় চলে যেতে বাধ্য হন।সেখানেই ১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর মৃত্যু বরণ করেন।কলকাতায় উনার নামে রয়েছে একটি সড়ক”অথচ নিজভূমে বেদখল হয়ে গেছে তার শৈশব কাটানো স্মৃতিবিজরিত পৈতৃকভিটা।

লেখক-
সুজন উল্লা
বার্তা সম্পাদক, হবিগঞ্জের সংবাদ।


Related Articles

Back to top button
Close