দেশজুড়েশিক্ষা সাহিত্য

আমার নাম সুতাং- আমি একটি নদী-বাহার উদ্দিন

প্রিন্ট করুন


আমার নাম সুতাং। আমি একটি নদী, আমি বাংলাদেশের বর্তমানে প্রবাহমান ২৩০ টি নদনদীর ৮২ তম সদস্য হিসাবে আমার অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের দীর্ঘ পথচলায় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত নদী সুতাং। আমি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় আন্তঃদেশীয় নদী হলেও আমার জন্ম কখন কিভাবে হয়েছে আমার জানা নেই। তবে এতটুকু জেনেছি যে, প্রকৃতি তার ভারসাম্য রক্ষায় তার প্রয়োজনেই আমাকে সৃষ্টি করেছে। আমি সর্পিলাকার পাহাড়ি স্রোতস্বিনী। আমার জন্ম ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ত্রিপুরা পাহাড়ের অসংখ্য পাহাড়ী ছড়ার মিলিত প্রবাহে।আমার ৮২ কিলোমিটার দীর্ঘ পথপরিক্রমায় হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট, শায়েস্তাগঞ্জ ও লাখাইর বিস্তীর্ণ পাহাড়, সমতল ভূমি পেরিয়ে লাখাইর পশ্চিম সীমান্তের ধলেশ্বরী নদীতে পতিত হয়ে মেঘনা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছি। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আমার দুই তীরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য নগর, বন্দর, হাটবাজার ও গঞ্জ। বিস্তীর্ণ মাঠ আমার জলকে কেন্দ্র করে হয়ে উঠেছে শস্য ভান্ডারে। পাহাড়ি নদী হলেও সমতলে আমি ছিলাম শান্ত জলরাশির ও দেশীয় মৎস্য সম্পদের আঁধার। আমার স্বচ্ছ জলরাশিতে দুকূলে বসবাসকারীরা নিয়মিত স্নান সমাপন ও প্রাত্যাহিক কর্মসম্পাদন করতো, তৃষ্ণা পেলে জলপান করতো। সারা বছর আমাতে মৎস্য আহরণকারীরা মৎস্য আহরন করে জীবিকা নির্বাহ করতো। হেমন্তে আমার দুকূলে শতশত সেচযন্ত্র বসিয়ে ধানসহ বিভিন্ন ফসল ফলাতো। আমার বুকের উপর দিয়ে চলতো পালতোলা নৌকা, লঞ্চ যা বর্তমানে শুধুই অতীত। আবহমানকাল থেকে বয়ে চলা আমাতে ক্রমাগত পলিমাটি জমে এবং দীর্ঘদিন যাবৎ খননের অভাবে আমার তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় দিন দিন আমার নাব্যতা হ্রাস পেয়ে কোথাও খালে আবার কোথাও নালায় পরিণত হয়েছে। মনুষ্য প্রজাতির নির্বিচারে অবৈধ দখল ও নানাভাবে অত্যাচারে আমি আজ জর্জরিত। তার পরও আমি আমার অস্তিত্ব কোনমতে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। এরই মধ্যে মরার উপর খাড়ার ঘা এর মতো ২০১৫ সাল থেকে হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায় গড়ে উঠা শিল্পকারখানার শিল্পবর্জ্যের দূষণের কবলে পড়ায় আমার জীবনে নেমে আসে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। শিল্পবর্জ্যের দূষণের প্রভাবে আমার জল গাঢ় কালোরঙ ধারণ করেছে। এতে দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। মাছসহ জলজ প্রানী শুন্য হয়ে পড়েছে। এক সময় যারা আমাতে স্নান সহ নিত্যকার কার্যাবলী সম্পাদন করতো আজ তারা পারতপক্ষে আমার নিকট আসে না আর যদিও আসে নাকে রুমাল চেপে আসে।
যাদের জন্য আমি জন্মাবধি নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে তাদের সেবা করে যাচ্ছি আজ তারা আমার এ করুন দশায় মুখ ফিড়িয়ে নিচ্ছে। এ দৃৃশ্য অবলোকন করে আমার বুকফাটা কান্না ও আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আসলেও সমাজের বিবেকবান মানুষের কর্ণকূহরে তা পৌঁছে না বা আমার আর্তনাদ তাদের শুনার ফুরসত নেই। আমি স্রোত হারিয়েছি, জৌলুস হারিয়েছি, অস্তিত্ব সংকটে তবুও আমাকে ভাববার মতো কেউ নেই। মাঝে মধ্যে পরিবেশবাদী লেখক ও সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচী নিলেও তাতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। আমি ভাবি জন্মই যেন আমার আজন্ম মহাপাপ। আমার করুন কাহিনী বিধৃত করলেও পাঠকদের জন্য কিছুই বলিনি কারন তাদের আমাকে নিয়ে ভাববার সময় আসেনি আর যখন আসবে তখন হয়তো করার তেমন কিছুই থাকবেনা বা প্রকৃতিই তা নির্ধারণ করে দিবে। প্রতিবেকের মন্তব্য , প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ ও প্রকৃতির সংঙ্গে যুদ্ধ করে কেউই জয়ী হতে পারেন না। এ যেন এক অসমযুদ্ধ। তাই প্রকৃতিকে শাসন নয়, একে তার মতো করে চলতে দেওয়া উচিৎ। নদীমাতৃক বাংলাদেশে অসংখ্য নদ নদী আজ অস্তিত্ব সংকটে আবার কোনটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। এখনই সময় এ বিলুপ্ত প্রায় নদীগুলো রক্ষায় সোচ্চার হওয়ায়। আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশের বিকল্প নেই। তাই আসুন সম্মিলিতভাবে পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ নদনদী কে বাঁচাতে যার যার অবস্থান থেকে চেষ্টা চালাই।আর এ ক্ষেত্রে সফলতা আনতে ব্যর্থ হলে প্রকৃতি আমাদের উপর কিভাবে প্রতিশোধ নিবে তা ভবিতব্যই জানে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার লুসিকান্ত হাজং এর বক্তব্য, সুুতাং নদী দূষণের উৎস যেহেতু শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায় সেহেতু এএমতাবস্থায় আমাদের তেমন করণীয় নেই, তবে এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের নিকট প্রতিবেদন পাঠাব যেন তারা এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন করেন।


Related Articles

Back to top button
Close