আজ ১৮ আগষ্ট বানিয়াচংয়ের মাকালকান্দি গণহত্যা দিবস

মোঃ নজরুল ইসলাম তালুকদার
আজ ১৮ ই আগষ্ট মাকালকান্দি গণহত্যা দিবস। হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার কাগাপাশা ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত একটি দূর্গম গ্রামের নাম মাকালকান্দি। ভাটি বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই গ্রামটি ছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অন্যতম টার্গেট। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট হবিগঞ্জ সার্কিট হাউজে (তৎকালীন মহকুমা) শান্তি কমিটির সাথে পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর কর্মকর্তারা এক সভায় বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় সশস্ত্র আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল ।
১৮ ই আগষ্ট ভোরে হবিগঞ্জ থেকে ৪০/৫০ টি নৌকায় বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও বানিয়াচংয়ের সৈয়দ ফজলুল হক মোত্তায়ল্লী এবং মতিউর ও স্থানীয় রাজাকারদের সাথে নিয়ে মাকালকান্দি গ্রামে যায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী।
নিরিহ গ্রামবাসী যখন চন্ডি মন্দিরে মনসা পূজোয় মগ্ন ছিল ঠিক সেই সময় চারদিক থেকে রাইফেল ও মেশিনগান দিয়ে অবিরাম গুলিবর্ষন করে শতাধিক মানুষকে হত্যা করে । তাদের তান্ডবে সারা গ্রাম জুড়ে এক নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়। যদিও সে সময় ৭৮ জনের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। লুটপাট ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল গ্রামের বেশ কয়েকটি বাড়ি ঘর । বর্ষাকালে মাকাল কান্দি গ্রামের চারিদিকে অথৈই পানি থাকায় নৌকা ছাড়া পালাবার আর কোন উপায় ছিলনা। অসহায় লোকজন কেউ পানিতে কেউবা ঝোপঝারে লুকিয়ে আত্রনক্ষার চেষ্ঠা চালিয়েও ব্যর্থ হন সে দিন। যারা আগ থেকে কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন কেবল তারাই নৌকা নিয়ে পালাতে পেরেছিলেন।
ছেলে হারা মিনতি রাণী পাল জানান, সেদিন হানাদার বাহিনীর সদস্যরা কোল থেকে আমার ৩ বছরের ছেলেকে কেড়ে নিয়ে গুলিকরে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছিল। এবং লাশগুলো সৎকার করার কোন উপায় ছিলনা বলে পচাঁ গন্ধের কারনে পাশের নদীতে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন নিহতের স্বজনরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিহতের অনেক স্বজনরা জানান, ধর্মীয় পরিচয়ে মাকাল কান্দি গ্রামের মানুষ হিন্দু সম্প্রদায় হওয়ায় পাক বাহিনী সেখানে স্মরণকালের নির্মম বিভিষীকাপুর্ণ গণহত্যা সংঘঠিত করে।
স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও সেই সাথে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের কাজ অতি দ্রুত কার্যকর করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের কাছে জোর দাবী জানান তারা।
২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট গণহত্যা দিবসে বানিয়াচং উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: নূরে আলম সিদ্দিকীর প্রচেষ্টায় এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। সেই থেকে দিবসটি পালন করছে স্থানীয় লোকজন।
পাকিস্তানীদের হাতে সেদিন যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন তাদের মধ্যে যাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে তারা হলেন, কর্ণমোহন চৌধুরী, কৃপেন্দ্র চৌধুরী, কানু চৌধুরী, গিরিন্দ্র চৌধুরী, ধীরেন্দ্র চৌধুরী, নকুল দাশ, প্রমোদ চৌধুরী, অন্নদা চৌধুরী, মীরালাল চৌধুরী, জহরলাল দাশ, গুনেন্দ্র দাশ, হরেন্দ্র চৌধুরী, ক্ষীরেন্দ্র চৌধুরী, গুরুচরণ চৌধুরী, রবীন্দ্র চৌধুরী, ফণিলাল দাশ, ইন্দ্রলাল দাশ, সরীন্দ্র দাশ, সূর্যমণি দাশ, অভিনয় চৌধুরী, গিরিষ চৌধুরী, জ্যোতিষ চৌধুরী, খোকা চৌধুরী, কুমেদ চৌধুরী, নৃপেন্দ্র দাশ, লবুরাম দাস, তরণী দাশ, দীনেশ দাশ, ঠাকুরচান দাশ, মনোরঞ্জন দাশ, খতন দাশ, সদয়চান দাশ, কুমোদিনী চৌধুরী, সরলাবালা চৌধুরী, ছানুবালা চৌধুরী, মিনুবালা চৌধুরী, তমালরাণী চৌধুরী, সুশীলাসুন্দরী চৌধুরী, নিত্যময়ী চৌধুরী, মুক্তলতা চৌধুরী, স্বপ্নারাণী চৌধুরী, ললিতারাণী চৌধুরী, মিলুরাণী চৌধুরী, পিলুরাণী চৌধুরী, উজ্জ্বলারাণী দাশ, সত্যময়ী দাশ, উন্মাদিনী দাশ, হেমলতা দাশ, সুচিত্রাবালা দাশ, ব্রহ্মময়ী দাশ, শুসীলাবালা দাশ, চিত্রাঙ্গ দাশ, বিপদনাসিনী চৌধুরী, সোহাগীবালা দাশ, শৈলজবালা দাশ, শোভারাণীবালা দাশ, অঞ্জুরাণী দাশ, মরীরাণী দাশ, লক্ষীরাণী দাশ, সোমেশ্বরী দাশ, চিত্রময়ী চৌধুরী, শ্যামলা চৌধুরী, তরঙ্গময়ী চৌধুরী, সরস্বতা চৌধুরী ও সরুজনী চৌধুরী।
এক সময়ে ধন সম্পদে সমৃদ্দ ভাটির জনপদের এই গ্রামের স্বজন হারানো পরিবারের দাবী সরকার দ্রুত শহীদদের নাম মুক্তিযুদ্ধের তালিকায় অন্তভূক্ত করা। গ্রামে বড় ধরনের স্মৃতিসৌধ ও পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট নিমার্ণ, স্কুল এবং বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থাসহ তাদের ন্যায্য স্বীকৃতি প্রদাণ করা। দিবসটি উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসন, মুক্তিযুদ্ধা সংসদ, আওয়ামীলীগ, বিএনপি এবং বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে।
এ ব্যাপারে বানিয়াচং- আজমিরীগঞ্জ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান জানান, ১৯৭১ সালের ১৮ আগষ্ট মাকাল কান্দি গ্রামে নিরীহ শতাধিক মানুষকে পাকিস্তানীরা গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে বানিয়াচং উপজেলা প্রশাসনের উদ্দ্যেগে এ গ্রামে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধাদের স্বরণে সেই সমস্ত শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষন করার জন্য বানিয়াচংয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে নতুন করে স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।